আপনি যে ভগবান
সরকার সাহেব অনেকদিন কোন এসএমএস দেননা। প্রতিবছর তার স্ত্রীর মৃত্যু দিবসে আমাকে এসএমএস দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতেন তার স্ত্রীর কথা। তাকে ফেসবুকেও পাইনা। অবশ্য অনেকদিন আগে তার প্রোফাইল সাময়িক ব্লক করে দিয়েছিলাম অস্বাভাবিক এক্টিভিটির কারণে। উনি বলতেন এসব অন্য কারও দেয়া, মানে হ্যাক। বুঝতে পারছিলামনা তার কথাই সত্য নাকি এসব তার একাকীত্বের মানসিক সমস্যা। তার স্ত্রী ক্রনিক মাইলয়েড লিউকেমিয়া নামক ব্লাড ক্যান্সারের রোগী ছিলেন। এর একমাত্র নিরাময়ী চিকিৎসা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে এভেইলেবল না। পার্শ্ববর্তী দেশে অনেক খরচ। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ লাখ বলে জানি। যাদের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা প্রযোজ্য না বা সম্ভব না তাদের জন্য রয়েছে মুখে খাওয়ার অত্যাধুনিক ওষুধ যা বাংলাদেশে পাওয়া যায় এবং বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো মানসম্মত ভাবে তৈরি করে থাকে; শুধু তাই নয়, বিদেশেও রপ্তানি করে। চিকিৎসকের ফলো আপ ও নির্দেশিত পন্থায় এই ওষুধ নিয়মিত সেবন করলে প্রায় সকল রোগী রোগমুক্ত স্বাভাবিক জীবন যাপন করে থাকে, যদিও পুরোপুরি নির্মুল হয়না।
ভদ্রমহিলা সর্বশেষ যেদিন এসেছিলেন সেদিন চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ মাথাটা ঝুকে আমার পায়ে সালাম করলেন। আমার থেকে বছর পনেরো বড় একজন মহিলা এভাবে আমার পায়ে ছুঁয়ে সালাম করবে তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। করে কি করে কি বলতে বলতেই উঠে দাঁড়িয়ে পা স্পর্শিত হাতটি নিজের মাথায় মুছতে লাগলেন।
আপনি এটা কি কাজ করলেন!
কোন উত্তর নেই।
আমিতো আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোটো। আপনি আমার মায়ের মত।
আপনি যে ভগবান……..।
অস্ফুট স্বরে মাত্র এতোটুকু উত্তর দিয়ে উল্টো মুখে হাটতে শুরু করলেন। আমি হতবাক। ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে আর আর তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছি। স্বামী ভদ্রলোক বললেন, উনি আপনাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন।
তাই বলে ….. ।
আমাদের ধর্মে অতি শ্রদ্ধেয় কাউকে ভগবানের আসনে বসানো যায়। উনি তার রোগ সম্পর্কে জানেন। ব্লাড ক্যান্সার যে নিরাময় হতে পারে, চিকিৎসা পেয়ে রোগী এভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে- এটা তার কাছে অবিশ্বাস্য। এটা তার কাছে ম্যাজিক। আপনি তার রোগ নির্নয় করেছেন, চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করেছেন, বাড়িতে বসে ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছেন।
আমি হা করে তার কথাগুলো গিলছিলাম। হ্যাঁ, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকে বলে বাড়িতে ওষুধ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। ডাক্তারের দায়িত্বের অতিরিক্ত এইটুকু করেছিলাম অবশ্য। ভদ্রমহিলাকে পুনরায় ডেকে বললাম, আমি একই সাথে আপনার ডাক্তার এবং একজন মানুষ হিসেবে আমার নিয়মিত কাজ করেছি মাত্র।
আপনি যে সাক্ষাৎ ভগবান…..।
তার পুনরুক্তিতে আমি আর কথা বাড়ালাম না। তার বিশ্বাসকে আর অসম্মান করতে চাইলাম না। ভগবান কখনো কখনো মানুষ রূপে পৃথিবীতে আসে – এরূপ বিশ্বাস অর্থাৎ অবতারবাদ কোন কোন হিন্দু সমাজে আছে, কিন্তু কখনো মানুষ থেকে ভগবান হয় বলে জানিনা। কি জানি! কোন বড় মাপের মানুষ অন্তত আমি নই এটা বুঝি। তবে আল্লাহর ইচ্ছায় এখন পর্যন্ত চিকিৎসা সম্পর্কিত বিষয়ে রোগীর স্বজনদের মারমুখী আচরণের শিকার হইনি। হয়তবা চিকিৎসা সেবার অন্যান্য বিষয়ের মত আমার বিষয়টি নয়। রোগীরা তাদের রোগের মাত্রা ও চরিত্র সম্পর্কে অবহিত থাকে। ডাক্তারদেরকে খোদার পরে কেউ কেউ স্থান দিলেও মানুষের জীবন মৃত্যুর ক্ষমতা ডাক্তাররা কখনও অর্জন করতে পারেনা। মাঝখানে বহুদিন তার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। কোন এক ঈদের ছুটিতে আমি গ্রামের বাড়িতে ফোন পেলাম।
স্যার, আমি সাতক্ষীরার আপনার অমুক রোগীর ছেলে। আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না।
গ্রামের বাড়িতে নেটওয়ার্ক ডিস্টার্ব করে তো। কি খবর?
আমার মা গুরুতর অসুস্থ্য। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। দাতের গোড়া দিয়ে রক্তও আসে।
দ্রুত কোন হেমাটোলজিস্টের অধীন ভর্তি করিয়ে দিন।
করেছি স্যার, বিএসএমএমইউতে। আপনাকে খুব ফিল করছি। মা আপনার কথা বার বার বলছিলেন। তাই আপনাকে জানালাম।
ওষুধ খাওয়া হয়নি অনেকদিন । বুঝলাম একিউটে কনভার্সন হয়েছে। আর হয়তো সাক্ষাৎ হবেনা। হয়ওনি। ভদ্রলোক একজন স্কুল শিক্ষক। ওষুধের খরচ চালানো তার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। শুনেছি নিয়মিত ওষুধ কিনতে পারতেন না। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ক্রনিক মাইলয়েড লিউকেমিয়া অনেক ক্ষেত্রে একিউট লিউকেমিয়ায় রুপান্তরিত হয়। অনিয়মিত ওষুধ সেবন করলে ওষুধের রেজিস্ট্যান্স হয়, অর্থাৎ ওষুধের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে ক্রনিক মাইলয়েড লিউকেমিয়া অনিরাময়যোগ্য অনিয়ন্ত্রণযোগ্য একিউট লিউকেমিয়ায় রুপান্তরিত হয়। স্বামী ভদ্রলোক ফোন করে জানিয়েছিলেন তার মৃত্যু সংবাদ। আরও কয়েকবার তার মৃত্যু দিবসে এসএমএস করে কিংবা ফোন করে স্মরণ করেছিলেন। জানি না ভদ্রলোক এখন বেচে আছেন কিনা।
Comments
আপনি যে ভগবান — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>