ক্যান্সার ভালো হয়
তিন চার বছর আগে এসেছিল। তখন ছিল ১১ বা ১২। মাসিক শুরু হয়নি। নিতান্ত নিরীহ। চুপচাপ। দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তার বাবার হাতে আল্ট্রাসনোগ্রামের একটি রিপোর্ট। ওভারি বা ডিম্বাশয়ে একটা চাকা বা টিউমার। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারীর সহকারী অধ্যাপক বন্ধু ডাঃ আসাদুজ্জামান শাহীনকে অনুরোধ করেছিলাম অপারেশন করতে। ওভারি ঠিক রেখে টিউমার ফেলে দিয়েছিল। টিউমার পরীক্ষা করে ক্যান্সার পাওয়া যায়।
এরপর এক ঘনিষ্ঠ ছোট ভাই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞকে বললাম কেসটা নিতে। সে বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলো। ওভারি রাখার কি দরকার ছিলো! ফেলে দিলেই ভালো হতো।
ডাঃ আসাদের কথা, ছোট মানুষ, বাকি জীবন পরে আছে। তাই ওভারি রেখেছি। আমি খুব দক্ষতার সাথেই টিউমার ফেলে দিয়েছি। লিটারেচার জেনে শুনেই আমি করেছি। যদি চাও আবার অপারেশন করে ফেলে দেই।
কেমোথেরাপি দেয়ার আগে অন্য সব পরীক্ষা নিরীক্ষার সাথে পুনরায় আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হলো। কিন্তু ওভারি পাওয়া গেলো না। ছোট ভাই এবার এক হাত নিলো। কিরে ভাই! কোন সার্জন দিয়ে অপারেশন করান আপনি?
আমি মোটামুটি বিব্রত। কেমোথেরাপি চললো। জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের শিশু বিভাগে। প্রথম কোর্স শেষ করার মাস খানেক পর ফলোআপ পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেল কোন কাজ তো হয়ইনি বরং টিউমারটি আগের চেয়ে বড়। ওভারিতেই। এবার ডাঃ আসাদ। তোমরা তো আমাকে পানির দরে বিচার করেছ। ওভারি যদি আমি ফেলেই দিয়ে থাকি তাহলে এখন এলো কই থেকে?
মেয়েটির বাবার সাথে আমি কথা বলতে পারছি না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। অথচ এখানে আমার ব্যবসায়িক কোন স্বার্থ ছিলো না। ছিল সেবা করার মানষিকতা। ক্যান্সার হাসপাতালের শিশু ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মমতাজ বেগমের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল। ফোনে বিষয়টা বললাম। উনি পরদিন তার অফিসে পাঠাতে বললেন। চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলাম। নতুন কোন অপারেশন হয়নি। তবে নতুন করে কেমোথেরাপি শুরু হলো।
এরপর আর যোগাযোগ ছিলনা। ধরে নিয়েছিলাম ক্যান্সার চিকিৎসা ফেল করেছে। মারা গেছে। তাই হয়তো আমার সাথে আর যোগাযোগ করেনি। মোটামুটি রকমের একটা অস্বস্তি। এধরণের একটা জটিল কেস যা আমার সাব্জেক্টেরও নয়। আর সবার মতো ডিসোল্ডারিং করলেই পারতাম। দোষ ঘাড়ে আসতো না।
আজ হঠাৎ এসে হাজির। বাবাকে চিনতে পারছি। কিন্তু মেয়েকে চিনতে পারছি না। সেদিনের সেই ছোটো মেয়েটি আর নেই। উদ্ভিন্নযৌবনা। পরিপূর্ণ নারী। স্মার্ট। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে।
আংকেল কেমন আছেন?
ভালো করে তাকিয়ে বললাম, তোমার বাবা তো আমাকে ভালো রাখেনি রে, মা।
বাবাকে বললাম, আপনি কি একটা মানুষ! সেই যে গেলেন। আর এলেন না। যোগাযোগ করলেন না। জানালেন না আপনার মেয়ে কেমন আছে? কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও তো একটা ফোন দিতে পারতেন। আপনি না জানালেও আমি ঠিকই খবর নিয়েছি।
মেয়ের বাবা চুপ করে আমার বকাবকি হজম করলো। মেয়টির মুখে হাসি। তৃপ্তি আর কৃতজ্ঞতার হাসি। নতুন শারীরিক সমস্যা নিয়ে এসেছে। কথা বার্তার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ক্যান্সারের রোগী ছিলে। মারা যেতে পারতে। অঙ্গহানি হতে পারতো। চিকিৎসার জটিলতায় স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হতে পারতো। সম্পুর্ণ নতুন জীবন পেয়েছো। এসব কি তোমার মনে আসে?
হ্যাঁ, আংকেল। খুব মনে আসে।
তখন তোমার কেমন লাগে?
মেয়েটি আর কথা বলতে পারছে না। গলা ভেঙে আসছে। চোখে জল। নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দের জল।
Comments
ক্যান্সার ভালো হয় — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>