থ্যালাসেমিয়া শেষ করল জীবন যৌবন
এক হাতে ক্রাচে ভর দিয়ে চেম্বারে ঢুকছিলেন মধ্য বয়সী ভদ্রলোক। গোঁফের জায়গায় সামান্য কিছু লোম, চোয়ালে দাঁড়ি বলতে কিছুই নেই। শ্বশ্রূবিহীন মানুষের বয়স আন্দাজ করা কঠিন। সাধারণত রোগী চেম্বারে প্রবেশ করা কালীন সময় থেকেই একজন ডাক্তার তার রোগীকে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। বসতে বললাম তাকে।
কি সমস্যা?
কোমরে প্রচণ্ড ব্যাথা।
আমার কাছে কেন?
আমি একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী। অমুক ডাক্তার পাঠিয়েছেন আপনার কাছে। বলেছেন আমার সমস্যাগুলোর সমাধান আপনিই দিতে পারবেন।
কতদিন থেকে ব্যাথা?
তা মাস খানেক হবে।
থ্যালাসেমিয়ার কারণে রক্ত নিতে হয়?
হ্যাঁ। প্রতিমাসেই।
কত বছর যাবত রক্ত নিতে হয়?
তেরো চৌদ্দ বছর হবে। আগে মাঝেমধ্যে নিতাম। এখন প্রতি মাসেই লাগে।
সব পেপারস চেক করলাম। হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস রিপোর্টটি নেই। একটা থ্যালাসেমিয়া সেন্টারের দূটি পেপারস পেলাম। তাতে রক্ত নেয়া ও প্রেসক্রিপশনের প্রমাণ পাওয়া গেলো। রক্তে আয়রন বা হেপাটাইটিস ভাইরাস চেকের কোন পেপারস নেই। নিয়মিত রক্ত যারা নেন তাদের রক্তে আয়রনের মাত্রা মাত্রা বেড়ে যায়। অনেক সময় তথ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়াতে রক্ত গ্রহণ ছাড়াই রক্তে আয়রনের মাত্রা বাড়ে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চমাত্রার আয়রন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করে। এর মধ্যে একটা হল অস্টিওপোরোসিস, মানে হাড়ে ক্যালসিয়াম কমে গিয়ে ভঙ্গুর হয়ে যায়। ভদ্রলোকের তাই হয়েছে। মেরুদণ্ডের হার ভেঙ্গে গিয়ে কোমরে ব্যাথা হচ্ছে। এক্সরেতেও স্পষ্ট।
আপনার যে মেরুদণ্ডের হার ভাঙ্গা এটা কি জানেন?
না তো।
কেউ বলেনি?
না। অমুক ডাক্তার সাহেবকে দেখিয়েছি। তার পরামর্শ মতই এক্সরে করা হয়েছে। বললেন না তো।
হয়তবা বলেছেন, হয়তবা বলেননি। বলে থাকলেও রোগীর বুঝানোর মত করে বলেননি। মেরুদণ্ড দেখেও সহজেই বোঝা যাচ্ছে ভাঙ্গার লক্ষণ। দেখিয়ে দিয়ে বললাম, এই যে মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে খেয়াল করেননি?
সাথে থাকা তার স্ত্রী বললেন, দেখেছি। মাস দুয়েক হবে।
আর কোথায় ব্যাথা?
সারা শরীরেই কম বেশি ব্যাথা। হাতের আঙ্গুলগুলোতে ব্যাথা। মুঠ করতে পারিনা।
এটা আরেকটা রোগ। অস্টিওআরথ্রাইটিস। জয়েন্টের ক্ষয় রোগ। রক্তে মাত্রারিক্ত আয়রনের কারণে হতে পারে। পেটে মাঝ বরাবর একটা বিশাল কাটা দাগ। স্প্লিন কেটে ফেলা হয়েছে।
স্প্লিন অপারেশন কতদিন আগে হয়েছে?
তা প্রায় ২১-২২ বছর হল।
কেন করা হয়েছিল?
অধিকাংশ উত্তর তার সাথে থাকা স্ত্রী দিচ্ছিলেন। বললেন, এইই বড় একটা পেট ছিল। চলাফেরায় কষ্ট হচ্ছিল। খেতে পারতো না।
তখন কি রক্ত নেয়া লাগতো?
না।
তাহলে রোগটা ধরা পড়লো কবে?
আমাদের বিয়ের পরে। তখনও কেউ জানতো না তার থ্যালাসেমিয়ার কথা… (মহিলার মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট)… জানতো নাকি ছাই… আমাকে বলেনি… ওনারা শুধু বলতেন জণ্ডিস… জণ্ডিস জণ্ডিস করে কবিরাজি চিকিৎসা করা হত… কাজের কাজ কিছু হতো না… শেষে লিভারের ডাক্তার মবিন খানের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ধরা পড়লো থ্যালাসেমিয়া… সব শেষ করেছি স্যার… সহায় সম্বল যা ছিল সব তার জন্য শেষ করেছি…
কি করেন? মানে পেশা কি?
আগে ব্যবসা করতো সে। এখন কিছুই করতে পারেনা।
সংসার চলে কিভাবে?
আমি গার্মেন্টসে চাকুরী করি। কোন রকমে চলছি।
ছেলেমেয়ে আছে?
একটা ছেলে। ইন্টারমিডিয়েট পড়ে।
তার কি অবস্থা?
সেও থ্যালাসেমিয়ার রোগী। বাহক।
অণ্ডকোষ শুকিয়ে এতো ছোট হয়েছে যে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। রক্তে মাত্রারিক্ত আয়রন কিংবা বারবার রক্ত নেয়ার কারণে হেপাটাইটিস ও সিরোসিস হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ শুকিয়ে যাওয়া ও যৌন ক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। জিজ্ঞেস করলাম, যৌন ক্ষমতা আছে?
মহিলাই বললেন, না, স্যার। কিছুই নাই।
কতদিন থেকে নাই?
সাত আট বছর। অবশ্য প্রথম থেকেই সে খুব একটা পারতো না…. কিন্তু বিগত সাত আট বছর ধরে কিছুই নাই… কি বলবো স্যার… আমি তো কোন অপরাধ করিনি… অথচ কিভাবে আমার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেলো…. এর মধ্যে একটা ছেলে হয়েছে…. ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়েই তার সাথে পড়ে আছি…..
ভদ্রমহিলার মুখের দিকে এবার ভালো করে তাকালাম। ফর্সা, সুন্দরী। বয়স প্রায় চল্লিশ। যৌবনের অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্ট এতক্ষণে তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। এই সমাজে এরকম একজন মহিলার এরূপ পরিস্থিতিতে সৎ থাকা সহজ নয় বৈকি।
Comments
থ্যালাসেমিয়া শেষ করল জীবন যৌবন — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>