নিজের পেশায় সৎ থাকুন, নিজ দেশের সৎ পেশাজীবীদের চিনুন
ল্যাবে টেকনিশিয়ানের সাথে এক লোক হৈ চৈ করছে দেখে এগিয়ে গেলাম। হাতে একটা সিবিসি রিপোর্ট। তার অভিযোগ হচ্ছে রিপোর্টটি ভুল। রিপোর্টটি হাতে নিয়ে দেখলাম দুপুরের প্যাথলজিস্টের সই। সিবিসি রিপোর্টগুলো অটোমেটিক মেশিনে করে স্লাইডের সাথে মিলিয়ে দেখে রিপোর্ট ছাড়া হয়।
টেকনিশিয়ানকে বললাম, স্লাইডটা বের করো দেখি।
স্লাইডর সাথে মিলিয়ে দেখলাম ঠিকই আছে। যদিও রক্ত সংগ্রহ থেকে শুরু করে রিপোর্ট প্রিন্ট করা পর্যন্ত অনেকগুলো স্টেপ থাকে এবং এর যেকোন একটি স্টেপে ভুল হলে ভুল রিপোর্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, কোন জায়গায় আপনার ভুল মনে হচ্ছে?
এই ধরেন হিমোগ্লবিন, ডব্লিউবিসি, নিউট্রোফিল …
কেন?
আমার রোগী কেমো পায়। ভেলোরে চিকিৎসা চলছে।
কিসের ক্যান্সার?
এএলসিএল।
এনাপ্লাস্টিক লার্জ সেল লিম্ফোমা। লিম্ফোমাগুলোর মধ্যে এটির নির্মুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি যদি সঠিক মাত্রায় কেমোথেরাপি দেয়া হয়। এটার জন্য ভদ্রলোক দেশের চিকিৎসায় আস্থা রাখতে না পেরে তার ১৩ বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে ভারতে গেছেন।
বললাম, কয়দিন আগে কেমো দেয়া হয়েছে?
এক সপ্তাহ।
কি কেমো?
ভিনব্লাস্টিন।
আর কিছু?
ভদ্রলোক বলতে পারলেন না। একটা নাম বলার চেষ্টা করলেন যেটা সম্ভবত কোট্রিম। বললেন, এটা ঢাকায় পাওয়া যায় না। লাজ ফার্মাতেও পাওয়া যায়নি।
ফিল্গ্রাস্টিম, লেনোগ্রাস্টিম জাতীয় কিছু দিয়েছেন?
না না। আরে ঢাকায় একজন আমার ছেলেকে ফিল্গ্রাস্টিম দিয়েছিল। ভেলোরের ডাক্তাররা এটাকে পাত্তাই দেয়নি। এটার প্রয়োজন না থাকলেও এখানকার ডাক্তার সেটা দিয়েছে।
ভদ্রলোকের কথা শুনে এবার আমার মেজাজ বিগরে গেলো। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি করেন?
এবার ভদ্রলোক থতমত। চুপ।
দেখুন, আপনি কি করেন সেটা আমার খুব একটা বিবেচ্য নয়। আপনি কি করেন জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্য হল আপনার বুঝার ক্যাপাসিটি কোন পর্যায়ের সেটা বুঝা। ভিনব্লাস্টিন এমন একটা কেমোথেরাপি যেটা দিয়ে সিবিসি প্যারামিটার খুব বেশি পরিবর্তিত হয়না। ফিল্গ্রাস্টিম বা লেনোগ্রাস্টিম দেয়া হয় নিউট্রোফিল বাড়ানোর জন্য। সেটা দেন নি। তারপরও আপনার কেন মনে হল রিপোর্ট ভুল।
এর আগে কেমো দেয়ার পর আমি আইসিডিডিআরবি থেকে রিপোর্ট করেছিলাম, সেখানে ডব্লিউবিসি কম পাওয়া গেছিলো।
এবার আমার মেজাজ আরও খারাপ হওয়ার পালা। তখনকার রোগের পর্যায়, কেমোথেরাপির ওষুধ ও মাত্রা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে সিবিসি রিপোর্ট পরিবর্তিত হয়। বললাম, দেখুন আপনার যেখানে আস্থা সেখানেই আপনার চিকিৎসা বা রিপোর্ট করা উচিৎ। আইসিডিডিআরবিতে আপনার আস্থা আছে সেখানে রিপোর্ট না করে এখানে কেন করেছেন?
এখানে রিপোর্ট করবনা! এসব প্রতিষ্ঠান তাহলে কেন আছে?
বাংলাদেশেও তো অনেক ভাল চিকিৎসক আছে। তাদের কাছে চিকিৎসা না করে ভারত গেলেন কেন?
বাংলাদেশে আবার ভালো চিকিৎসা হয় নাকি!
নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, দেখুন, আমি একজন হেমাটোলজিস্ট। আমিও ব্লাড ক্যান্সার লিম্ফোমার চিকিৎসা করি। এএলসিএল দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা করতে হয়। চিকিৎসার শুরু কিন্তু এদেশের ডাক্তাররাই করেছে। তারা কিন্তু আপনার ছেলেকে মেরে ফেলেনাই। রোগ জটিল করেনাই। চিকিৎসা দিয়ে আপনাকে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার সময় করে দিয়েছে।
ভদ্রলোক সন্তোষ্ট নন বুঝা যাচ্ছে। বললাম, আপনার যদি মনে হয় এই রিপোর্টটি ভুল আছে তাহলে আরেক জায়গা থেকে আজই পরীক্ষা করুন। তারপর চ্যালেঞ্জ করুন।
না আমার চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছা নাই।
তাহলে রিপোর্ট মেনে নিয়ে আপনার ডাক্তারকে দেখান। আর শুনুন। ভারতের ডাক্তারদের সম্পর্কে আমি জানি। এই যে পাত্তা না দেয়ার কথা বললেন এটা আপনার ভাষা, তাদের নয়। ভারতের ডাক্তাররা পাত্তা দিলো কি না দিলো তার উপর এদেশের চিকিৎসা চলেনা। এদেশ থেকে ১০ টা রোগী যদি ভারতে যায়, তাহলে মনে রাখবেন, আরও ১০ হাজার রোগী এদেশের চিকিৎসায় ভাল হয়।
ভদ্রলোক উঠলেন। বললেন, আপনি আমার ডাক্তার না হওয়া সত্বেও অনেক খানি সময় দিয়েছেন এজন্য ধন্যবাদ।
ভদ্রলোক দেখি ধন্যবাদ দিতেও জানে ! বললাম, আরেকটা কথা বলি। আপনি কি করেন জানিনা। তবে নিজের পেশায় সৎ থাকুন, তাহলে নিজ দেশের সৎ পেশাজীবীদের চিনতে পারবেন এবং সম্মান করতে পারবেন।
Comments
নিজের পেশায় সৎ থাকুন, নিজ দেশের সৎ পেশাজীবীদের চিনুন — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>