নিজ পেশার প্রতি সম্মান রাখুন
হন্তদন্ত হয়েই চেম্বারে প্রবেশ করলেন তিনি। কিছু পেপারস বের করে দিলেন।
কি ব্যাপার? কোন খবর না দিয়ে হঠাৎ?
আপনার ফোন নম্বরটা হারিয়ে ফেলেছি।
আপনার বোনেরটাও?
মুখে কাচুমাচু ভাব।
তিনি আমার শ্বশুর পক্ষীয় এক আত্মীয়। পঞ্চগড় থেকে এসেছেন। থ্যালাসেমিয়ার বাহক। ই-ট্রেইট। রংপুরের একজন চেস্ট স্পেশালিষ্টের হাতেই রোগটি ধরা পরেছে। ঢাকার প্রথম শ্রেণীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট। এরপর উনি শ্যামলীতে একজন হেমাটোলজিস্টকে দেখিয়েছেন, তারপর আমার কাছে। ডাক্তার নাড়াচাড়ার অভ্যাস আছে আর কি!
উনি আপনাকে চিনেন। (মুখে তৃপ্তির ছবি।)
হ্যাঁ, আমিও উনাকে চিনি। দেশে হেমাটোলজিস্ট তো খুব বেশি নেই, আমরা সবাই সবাইকে মোটামুটি চিনি।
কি করি বলুন তো।
কিছু করার দরকার নাই। শুধু ফ্যামিলি স্ক্রিনিংটা করে নিবেন।
না, মানে, আমার তো কোন সমস্যাই নেই। তারপরও এই রকম রিপোর্টের মানে কি?
ই-ট্রেইট বা ই-বাহকদের কোন লক্ষণ থাকেনা। এমনকি ই-ডিজিজের ক্ষেত্রেও কোন লক্ষণ থাকেনা। তাদের হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে। ফ্যামিলিতে যদি এধরনের রোগ থাকে, কিংবা অন্য রোগের পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি সন্দেহ হয় তাহলেই সাধারণত এর পরীক্ষা করা হয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের ইতিহাস জানা থাকলে এধরণের হঠাৎ আবিষ্কৃত রোগের রিপোর্টের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়।
প্রেস্ক্রিপনে লিখে দিলাম ‘ই-ট্রেইটের জন্য এই মুহুর্তে চিকিৎসার প্রয়োজন নেই’। সাথে ফ্যামিলি মেম্বারদের সবার জন্যই ‘হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস’ নামক পরীক্ষা করতে লিখে দিলাম।
আমার স্ত্রীরও কি পরীক্ষা করতে হবে?
আপনি না খালাত বোনকে বিয়ে করেছেন!
আর বলেন না, ভাই। ছোট বেলার কাহিনী যে। কেন যেন অন্যদের চেয়ে একটু অল্প বয়সেই আয়না দেখতে শুরু করেছিলাম। এই জন্যই আর বেশি দূরে যাওয়া হয়নি। হাহাহা।
ফ্যামিলি স্ক্রিনিং করা হয় বিশেষত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাথায় রেখে। এই ব্যক্তির দুটো বাচ্চা আছে। তারা আপাত সুস্থ থাকলেও বাহক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি তারা বাহক হয় তাহলে তাদের বিয়ের সময় সতর্ক হতে হবে। একজন ই-বাহক যদি বিটা থ্যালাসেমিয়া বাহককে বিয়ে করে তবে তাদের প্রতিটি বাচ্চার ক্ষেত্রে ২৫% সম্ভাবনা থাকে ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া হবার যা অনেক সময় মারাত্মক হয়ে প্রকাশ পায়। প্রায়ই তাদের নিয়মিত বা অনিয়মিত অন্যের রক্ত গ্রহনের প্রয়োজন হয়। এই সমস্ত রোগী পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে, অন্যের করুণা প্রার্থী হয়ে অমানবিক জীবনযাপন করতে হতে পারে। সেজন্য প্রতিরোধের জন্যই ফ্যামিলি স্ক্রিনিং ও সঠিক পাত্রপাত্রীর মধ্যে বিয়ে হওয়া প্রয়োজন। নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে অসুস্থ বাচ্চা জন্মের সম্ভাবনা স্বাভাবিক কারণেই আরও বেশি থাকে। এই কারণে নিকটাত্মীয়ের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে বিয়ে হওয়া উচিৎ নয়। তবে এই পরীক্ষাই চূড়ান্ত নয়। রিপোর্টের ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে জিন পরীক্ষা করা হয়।
ভাই, পরীক্ষাটা ইন্ডিয়াতে করলে হবেনা?
দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সংবরণ করলাম। বললাম, কেন হবেনা? মশা যদি হাত দিয়েই মারা যায়, তাহলে তা কামানের গোলা দিয়েও মারা যাবে।
না, মানে, ভিসার মেয়াদ আছে তো। খরচ করে আসি।
কোথায় যাবেন?
দার্জিলিং। ফ্যামিলি ট্যুর।
তাহলে শিলিগুড়িতে করে নিয়েন। কিন্তু ‘ক্যাপিলারি ইলেট্রফোরেসিস’ যেন হয়। ‘ই’ ধরার জন্য ক্যাপিলারি খুবই কার্যকর।
আমি জানিনা শিলিগুড়িতে স্বাস্থ্য সার্ভিসের অবস্থা কেমন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সার্ভিসের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান নিয়ে একটা র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকার পরেই বাংলাদেশের অবস্থান, ২য়। বিশ্বে ৮৮। আর ভারতের অবস্থান ১১২, অনেক তফাৎ। তবুও আমরা ভারত বলতে পাগল। অবশ্য এখনও অনেক সুবিধা আমাদের হাতে নেই যেগুলো ভারতের কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছে, ঢালাও ভাবে ভারত নয়। কিন্তু এইরকম সামান্য বিষয়ে বিদেশে গিয়ে দেশের টাকা খরচ করার কোন মানে হয় না। আসলে এ ধরণের আচরণগুলো আমাদের পারস্পরিক অনাস্থার ফল, আমাদের নিজ নিজ পেশাগত ক্ষেত্রে অদক্ষতার প্রতিফলন। যখন কেউ নিজের পেশায় অসৎ বা অদক্ষ, তখন সে আরেকজনের প্রতি বা আরেক পেশার প্রতিও আস্থা রাখতে পারেনা। যদিও আমাদেরও অনেক সাফল্যের কাহিনী আছে। মিডিয়ার পজিটিভ নিউজ গুলো আমাদের আত্মবিশ্বাসী জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
Comments
নিজ পেশার প্রতি সম্মান রাখুন — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>