নেগিন মুরাদিঃ আমার ইরানি বৌমা
অগণিত ইরানী সুন্দরীর চেহারা দেখতে দেখতে যখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি তখনই পরিচয় হয় নেগিন মুরাদির সাথে। যেমনি গায়ের রঙ, তেমনি তার মুখাবয়ব, সোনালী চোখ। ইরানীদের নাক আক্ষরিক অর্থেই উঁচু বা লম্বা হয়। গর্বিত জাতি বলেই হয়ত এদের বা এদের জাতভাই আর্যদের নাকের গঠনের কারণে বাংলা ভাষায় অহংকারী ব্যক্তির আরেক নাম ‘নাক উচু’। কিন্তু নেগিনের নাক যথার্থই সুন্দর। শীতের পরিপাটি পোশাকের সাথে ইরানী স্কার্ফ। অপুর্ব লাগছিল তাকে। বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ক্লিনিকে সে বসে আছে। আমরা একজন করে রোগী দেখে দেখে বিদায় দিচ্ছি আর সে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে রোগীর কিউ ধরে। প্রথমে বুঝতে পারিনি সে রোগী না রোগীর এটেন্ডেন্ট। বয়স মাত্র ১১।
আমার কলিগ ডাঃ মরিয়ম বেহফারকে বললাম, মেয়েটা কিন্তু আসলেই সুন্দরী।
বেহফার নিজেও সুন্দরী। সদা হাস্যময়ী। আমাকে অনেক হেল্প করেছে। হাসলে আরও সুন্দর লাগে। হাসি দিয়েই বলল, হ্যাঁ, মেয়েটা সুন্দরী। ইরানী মেয়েদের মধ্যে গড়পড়তার চেয়ে সুন্দরী।
মেয়েটিকে বললাম, তুমি তো ভারী সুন্দর!
আমার কথাটি ফার্সিতে ট্রান্সলেট করে দিল বেহফার। শুনে সে হাসতে থাকল। তার হাসিতে তাকে আরও সুন্দর ও মায়াময় লাগছিল।
তার কাগজ পত্র দেখলাম। হ্যাঁ। সে নিজেই রোগী। শুরুতে থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়া ছিল, অর্থাৎ মাঝে মাঝে রক্ত নিতে হত। কিন্তু বিগত বছর চারেক থেকে নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য এসেছে। খুব আশ্চর্য হলাম। এত জটিল একটি রোগ, অন্যের রক্ত নেয়াটা তার নিয়মিত কাজের একটি, দৈনন্দিন কাজ যার বিঘ্নিত হওয়ার কথা, সে এত সুন্দর থাকে কি করে! হ্যাঁ। থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসা এমনই হওয়া উচিৎ। তাছাড়া ট্রান্সপ্লান্টের জন্য শারীরিক ফিটনেস প্রয়োজন। যে সব থ্যালাসেমিয়া রোগীকে নিয়মিত রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয় তাদেরকেই ট্রান্সপ্লান্টের জন্য বাছাই করা হয়। নিয়মিত রক্ত গ্রহণের কারণে শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং তা বিভিন্ন অঙ্গে জমা হতে থাকে যা ক্ষতিকর। এই আয়রন শরীর থেকে বেড় করে দেয়ার জন্য কোন অঙ্গ নাই। ফলে ওষুধের মাধ্যমে চিলেশনই (Chelation) একমাত্র উপায়। রক্ত গ্রহণ জনিত অতিরিক্ত আয়রন বা ইনফেকশনের কারণে লিভারে সিরোসিস হতে পারে। নিয়মিত রক্ত গ্রহণ না করলে লিভারে রক্ত তৈরি হয় এবং সে ক্ষেত্রে লিভারের সাইজ বড় হয়ে যায়। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য নির্বাচিত থ্যালাসেমিয়া রোগীদেরকে আয়রন চিলেশনের জন্য নিয়মিত চিকিৎসা ও আয়রনের অবস্থা, লিভারের সাইজ এবং লিভারের কার্যকর অবস্থার উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিভাগ করা হয়। যাদের নিয়মিত আয়রন চিলেশন করা হয়, লিভারের সাইজ ঠিক থাকে ও লিভারে কোনরূপ সিরোসিস বা ফাইব্রোসিস থাকেনা তাদের ট্রান্সপ্লান্ট রেজাল্ট খুব ভাল। নেগিনকে এসব চিকিৎসা সঠিকভাবে দেয়া হয়ছে বলেই আপাত দৃষ্টিতে রোগের কোন লক্ষণ চোখে পড়েনা। ক্লাস ওয়ান অর্থাৎ সর্বোত্তম শ্রেণীতে ছিল সে। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য সে প্রস্তুত। কিন্তু সিট খালি নেই। ৫০ বেডের বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টারটিতে শিশুদের জন্য ১০ টি বেড নির্ধারিত। সরকারী খরচে চিকিৎসা হয়। ফলে সারাদেশ থেকে রোগী আসে এবং রোগীর প্রচণ্ড চাপ। ডাঃ বেহফারের সাথে নেগিনের মা কথা বলছে। অনেক কাকুতি মিনতি করছে। নেগিন যতটা সুন্দর, তার মা যেন ঠিক ততটাই অসুন্দর। মেয়ে আর মা একেবারে উলটো। বিদঘুটে চেহারা। ময়লা রং। যেভাবে কাকুতি মিনতি করছে তাতে তাকে আরও বিদঘুটে লাগছে। পরবর্তি তারিখ দেয়া হল আসার জন্য।
আবার এসেছে মেয়েটি। আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। বললাম, আমার একটা ছেলে আছে। ঠিক তোমার মত বয়স। আমার ছেলেকে বিয়ে করবে?
প্রথমে সে বুঝতে পারেনি। ট্রান্সলেট করে দেয়া হলে সে আচমকা হাসতে শুরু করে দিল শব্দ করে। সে হাসি আর থামেনা।
আমার ছেলেটাও কিন্তু সুন্দর। তোমার পছন্দ হবে।
আবারও হাসি। ইরানে সমবয়সী বা বেশী বয়সী মেয়েদের বিয়ে করার নজির অনেক বেশী।
মেয়েটির মা এবার কথা বলতে শুরু করল, তাহলে তো তুমি আমার আত্মীয় হয়ে গেলে। এখন তোমার বৌমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবে নাকি তোমার ছেলেই ইরানে আসবে? হাহাহাহা
সেদিনও ফেরত গেল সে। সিট নাই। যে তারিখে আসতে বলা হয়েছিল, সে তারিখ তারা মিস করেছে। মাস খানেক পর আবার এসে হাজির। গত দিনে ডাঃ বেহফার ছিল না। আজ সে ক্লিনিকে উপস্থিত। বলল, ডাঃ হাসান, তোমার সুন্দরী এসেছে।
রহস্য করে বললাম, আমি তো তাকে প্রপোজ করেছি।
মানে!! ডাঃ বেহফার আকাশ থেকে পড়ল। মুখ কালো করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে সাথে সাথেই বললাম, আমার ছেলের জন্য প্রপোজ করেছি। বৌমা বানাতে চাই।
ও। তাই বল। আমি কি সব তোমার সম্পর্কে ভাবছিলাম। ভাবছিলাম চাইল্ড মেরেজের আরবিয় কালচার তোমাদের দেশেও আছে নাকি!
ইরানীরা আবার আরবদের খুব ঘৃণার চোখে দেখে। সবসময় খেয়াল করেছি তারা আরবদের থেকে নিজেদেরকে আলাদা প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
তা, সে কি এক্সেপ্ট করেছে?
এক্সেপ্ট করেছে বলেই তো মনে হয়। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। নারাজি তো হয় নাই।
বেহফার এবার নেগিনকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি তার ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ?
আবারও হাসি।
এদিনও সে ভর্তি হতে পারলনা। রমজান মাসে আবার এল। ডাঃ বেহফার আগেই তাকে দেখে ফেলেছে।
তোমার বৌমা এসেছে।
সেও হাসতে হাসতে সরাসরি আমার সামনে এসে বসে পড়ল। আজ তো তাকে ভর্তি করতেই হবে। ভর্তি হল। ডাঃ বেহফার তার ফলো আপের দায়িত্ব আমাকেই দিল। বলল, তোমার বৌমাকে তুমিই দেখ।
আমিও খুশি। ভর্তির পর তার সাথে কথা বলছিলাম। এই প্রথম তাকে স্কার্ফ ছাড়া দেখলাম। চুলগুলোও খুব সুন্দর। বললাম, তোমার তো এই সুন্দর চুল থাকবে না।
মানে?
মানে ট্রান্সপ্লান্টে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার কেমোথেরাপি দেয়া হয়। তাতে তোমার সব চুল উঠে যাবে।
ও। তাই বল। আমি সেটা জানি। আমার চুল আরও সুন্দর ছিল। লম্বা ছিল। এই দেখো।
বলেই সে তার এন্ড্রয়েড মোবাইল বের করে তার চুলের ছবি দেখাতে লাগল। অনেক লম্বা। একদম পায়ের পাতা পর্যন্ত লম্বা। পারিবারিক অনুষ্ঠানে সে চুল সাজিয়ে নাচ গান করত। ট্রান্সপ্লান্টে কেমোথেরাপির কারণে যে চুল পরে যায় তা তাকে জানানো হয়েছিল। একারনেই সে ভর্তি হওয়ার আগে চুল কেটে সংরক্ষণ করে রেখেছে। আসলে এটাই নিয়ম যে এধরণের একটা বড় চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই চিকিৎসার প্রজ এন্ড কঞ্জ, সাইড এফেক্ট, সাফল্য ব্যার্থতা বিস্তারিত বলা হয়।
কিছুক্ষণ পরই হেড নার্স তাকে ওটিতে পাঠিয়ে দিল। সিভি লাইন বা সেন্ট্রাল ভেনাস লাইন লাগানো হবে। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করতে এতো এতো কেমোথেরাপি, ইম্যুনোসাপ্রেসিভ, এন্টিবায়োটিক, ব্লাড, আরো কত হরেক রকম ওষুধ শরীরে প্রয়োগ করা হয়। প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষার জন্য ব্লাড টানতে হয়। ফলে সিভি লাইন প্রতিটা রোগীকেই লাগানো হয়। ওটি থেকে ফেরার পর নিয়মিত চেকআপের সময় দেখলাম সে ভয়ানক অসুস্থ। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেন লাগানো হল। নিয়ম মাফিক সিভি লাইন লাগানোর পরই একটা এক্সরে চেক করা হয়। তখনও এক্সরে আসেনি। অপেক্ষায় আছি। হাসপাতালের ডেস্কটপ চেক করছি বারবার। প্রতিটা রোগীর রিপোর্ট ও অন্যান্য তথ্য হাসপাতালের নিজস্ব সার্ভারে দেয়া হয়। যে যার মত যেকোন ওয়ার্ডে থেকে অনলাইনে সেখানকার ডেস্কটপ থেকে দেখে নিতে পারে। কিছুক্ষণ পরই তার এক্সরে পেলাম। সিভি লাইন লাগাতে গিয়ে ফুসফুসের থলেতে বাতাস ঢুকে গেছে। ডাক্তারি ভাষায় যাকে নিউমোথোরাক্স বলা হয়। অনেক সময় মারাত্মক হলে জীবন হানি পর্যন্ত হতে পারে। এদেরও ভুল হয়, ফেল হয়। এতো এতো টেকনোলজি ব্যবহার করার পরও। মনে পরল আমার বন্ধু ডাঃ মোস্তাফিজের কথা। সিভি লাইনের ওস্তাদ। অনেক জটিল কাজও সে অনায়াসে করে আল্ট্রাসনোগ্রাফিক সাহায্য ছাড়াই। চেক এক্সরেও কদাচিৎ করে সে। তাকে কখনও ফেল করতে দেখিনি। হ্যাঁ, একবার সে ফেল করেছিল। নিডল ভেঙ্গে ফেলেছিল। সেই রোগিটাও একটা সুন্দরী মেয়ে ছিল। সাথে সাথেই সিভি লাইন খুলে দিলাম। অবস্থা সেটল্ড হলে দুইদিন পর তাকে ছুটি দেয়া হল।
একমাস পর আবারও তাকে ভর্তি করানো হল। এবার তার মা খুবই অনুনয় বিনয় করছে।
দেখুন, আমার এতিম মেয়েটিকে দয়া করুন। এবার যেন আর ভুল না হয়।
এতিম মানে? আমি খুব আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
মেয়েটা এতিম। বাবা মা বেচে থেকেও নেই। বাবা মা ভালবেসে বিয়ে করেছিল। আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে নয়, অনাত্মীয় বিয়ে। যদিও ইরানী সমাজে আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে করার প্রবণতা অনেক বেশী এবং এই কারণে এখানে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যায়ও বেশী। বিবাহপুর্ব থ্যালাসেমিয়া নির্নয়ের পরীক্ষার জন্য এদেশে আইন আছে বলে শুনেছি। ভালবাসার বিয়ের কারণেই হয়তো কেউ আর নিজেদের এই পরীক্ষা করেনাই। বিয়ের পর তাদের দুটি সন্তান হয়। বড় সন্তান ছেলে। সেই নেগিনের ডোনার। বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট। নেগিনের জন্মের পর অনেকদিন কিছু বুঝা যায়নি। বয়স বছর দুয়েক হলে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তখন পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া নিশ্চিত হয়। বাবা মা দুজনই ট্রেইট। অতঃপর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ। স্বামী ও সন্তানদেরকে ছেড়ে তাদের মা অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যায়। ঠিক কি কারণে তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে তা নিশ্চিত ছিলাম না। তবে তার এই কথিত মা বলছে যে তারা আর অসুস্থ বাচ্চা পয়দা করতে চায়না বলেই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাতৃতান্ত্রিক ইরানী সমাজে বিবাহ ও সংসারে মহিলারা মাত্রারিক্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে। বাবাটি আর বিয়ে করেনি। এই মহিলা হচ্ছেন নেগিনের জ্যাঠাই মা। সেই থেকেই নিজের সন্তানের মত করে মানুষ করছেন। নেগিনের চিকিৎসার ব্যাপারে তার আকুতি আর তৎপরতায় কখনই মনে হয়নি যে তিনি জন্মদাত্রী নন। শুনতে শুনতে চোখ ভারী হয়ে এলো। মানুষ কত ভাল হতে পারে! মায়েরা কত মমতাময়ী হতে পারে! নেগিনের জন্মদাত্রীও মা, এই মহিলাও মা। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো।
Comments
নেগিন মুরাদিঃ আমার ইরানি বৌমা — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>