প্রবাসীর স্ত্রী …
বলছে ১৮। আসলে বয়স ১৭। আরও দুই বছর আগেই বিয়ে হয়েছে। বিয়ের ছয় মাস পরই স্বামী চাকুরী করতে মধ্যপ্রাচ্যে গেছে। মাস খানেক ধরে অসুস্থ। শরীর দুর্বলতা, ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া। গত মাসিকের রক্তক্ষরণ বেশি হয়েছে। শরীরে আর কোন লক্ষণ নাই। এপ্লাস্টিক এনিমিয়া। এই রোগে রক্ত উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় বা কমে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ জানা যায়না। চিকিৎসা বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, যা এখনো আমাদের দেশে শুরু হয়নি। অত্যন্ত ব্যায়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা। তার উপর ডোনার থাকতে হয়, বিশেষ করে সহোদরদের মধ্য থেকে। বিকল্প যে চিকিৎসা আমাদের দেশে পাওয়া যায় তাও অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে।
সাথের পুরুষ লোকটি রোগিণীর ননদের স্বামী। রোগিণীর সামনেই কথা হচ্ছিল। রোগীর মুখে কোন ভাবান্তর দেখলাম না। মনে হচ্ছিল সে তার পরিণতি নিষ্ঠুরভাবে মেনে নিয়েছে।
স্যার, এটা কি ব্লাডক্যান্সার?
না। তবে অনেক ক্ষেত্রে ব্লাডক্যান্সারের চেয়েও খারাপ।
বিকল্প চিকিৎসার খরচের হিসাব দিলাম। রোগিণীর শরীরের ওজন অনুযায়ী ওষুধের দামই পড়বে প্রায় আট লাখ টাকা।
স্যার, আমাদের তো প্রস্তুতির জন্য কয়েকদিন সময়ের প্রয়োজন। আপাতত কিছু চিকিৎসা দিন।
মুখে খাওয়ার ওষুধ আর প্রয়োজনীয় রক্ত সঞ্চালণের পরামর্শ দিয়ে বললাম, সময় বেশী নিবেননা। চার পাচ দিনের জন্য দেশের বাইরে থাকবো। অমুক দিন আমাকে ফোন দিয়ে হাসপাতালে এসে ভর্তি হবেন।
বিদেশ থেকে ফেরার পর নির্ধারিত দিনেই আমাকে ফোন দিয়ে চেম্বারে হাজির।
স্যার, আমাদের আরও কয়েকদিন দেরি হবে। রক্ত নেয়ার প্রয়োজন থাকলে লিখে দিন।
ওষুধগুলো খাওয়ানো হচ্ছে তো?
হ্যাঁ। ওষুধ চলছে।
রোগিণী বরাবরের মতই চুপ। প্রেসক্রিপশন নবায়ন করে দিলাম। এরপর সপ্তাহ দুয়েক কোন খবর নাই। আবার এসেছে। এবার রোগিণীর সাথে মুরুব্বী গোছের এক মামা। ‘ডঃ কি যেন’ নাম বললেন। আমি মেডিকেল ডঃ মনে করে কথা বলছিলাম। পরে শিওর হলাম উনি ননমেডিকেল পিএইচডি ডঃ একজন।
ডাক্তার সাহেব, আমরা তো ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পাসপোর্ট পেয়ে যাব। ভিসা হতে আরও কয়েকদিন লাগবে। এই সময়ের জন্য যা চিকিৎসা লাগে দিন।
ইন্ডিয়া যাবেন কেনো?
শুনেছি ওখানে চিকিৎসা খরচ কম।
ইতিমধ্যে রোগীর গায়ে জ্বর চলে এসেছে। বললাম, আপনারা তো সময় পাবেননা।
কেনো পাবো না?
রোগের প্রকৃতি পুনরায় তাকে বুঝিয়ে বললাম। বললাম, আপনি যদি বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের জন্যও ইন্ডিয়া যেতে চান তবুও সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে বিকল্প চিকিৎসা নিয়ে রোগীকে বাচিয়ে রাখতে হবে।
ভদ্রলোক শুনে ঘামতে শুরু করলেন। এতো কথা তো উনারা আমাদেরকে বলেননি!
ওষুধ?
ওষুধও কেনা হয়নি।
রোগিণী ঠিক আগের মতই নির্বিকার। যেন শ্মশানে যাওয়ার জন্য রেডি। পরদিন রোগীর ননদের স্বামী ফোন দিয়েছিল। বললাম, আপনারা নাকি ইন্ডিয়া যাচ্ছেন?
তাই নাকি! ইন্ডিয়া যাবে?
কণ্ঠস্বরে একটা তাচ্ছিল্যের সুর!
এরপর আর আসেনি। কথাও হয়নি। আগেই তো সে মৃত। এতো দিনে তার দেহ দাহ করা হয়েছে। শুনলাম রোগীর মা জমি বিক্রি করে ষাট হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এফেরেসিস প্লেটলেট প্রতিবারে ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়। দুইবার এফেরেসিস প্লেটলেট, কয়েক ব্যাগ রেড সেল, পরীক্ষা নিরীক্ষা। হিসাব করে দেখলাম এপর্যন্ত খরচ কোন অবস্থাতেই ৬০ হাজারের বেশি নয়। কিন্তু তার প্রবাসী স্বামীর কাছে নাকি বিল দেয়া হয়েছে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা।
Comments
প্রবাসীর স্ত্রী … — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>