প্রেম ও জীবন
চার পাঁচ বছরের প্রেম। শিক্ষাজীবন শেষ করে এখন বিয়ে করার পালা। উভয়ের ফ্যামিলিতে বিয়ের প্রস্তুতিও চলছে। কিন্তু মেয়েটি অস্থিরতায় ভুগছিল। বয়ফ্রেন্ডকে সাথে নিয়েই চেম্বারে হাজির।
কি সমস্যা?
স্যার, আমরা দুজন বিয়ে করতে চাই। (সেরেছে রে। ডাক্তারের চেম্বারে মনে হয় ভূল করে এসেছে। আমার ছোখ দুটো স্থির হয়ে গেলো।)
বিয়ে করবেন তো আমার কাছে কেনো? আমি তো কাজী নই। ডাক্তারি করি।
আমরা মনে হয় ঠিক জায়গাতেই এসেছি, স্যার। আপনি ডাক্তার এবং একজন হেমাটোলজিস্ট। রক্তের রোগের চিকিৎসা করেন। মেয়েটি বলে যাচ্ছিল।
হ্যাঁ।
বেশ কয়েক বছর আগে অন্য এক সমস্যার কারণে আমার রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছিল। তাতে আমার বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট পাওয়া গেছে। (যাক। শেষ পর্যন্ত আর কাজীগিরি করা লাগলো না। আগমনের হেতু পরিষ্কার।)
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। এতে রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায়। এর অনেক রকম আছে। বাংলাদেশে হেমোগ্লোবিন ই এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া বেশী পাওয়া যায়। এগুলো ট্রেইট বা ডিজিজ বা কম্বাইন্ড হেটেরোজাইগোট হতে পারে। ট্রেইট বলতে থ্যালাসেমিয়ার বাহক বুঝানো হয়। বিজ্ঞানের ছাত্ররা মেন্ডেলের সূত্রের সাথে পরিচিত। থ্যালাসেমিয়া বা হিমোগ্লোবিনের বংশগত রোগগুলো মেন্ডেলিয়ান সুত্র ফলো করে। মানে মানুষের শরীরের প্রতিটা বৈশিষ্ট্যের জন্য সাধারণত দুটি করে জিন থাকে যা কোষের ক্রোমজম নামক অংশে অবস্থান করে। এর একটি বাবার কাছ থেকে, অপরটি মার কাছ থেকে আসে। বাবা ও মায়ের কাছ থেকে আসা দুটি জিনের একটি অসুস্থ হয়ে থাকলে অপরটি কাজ চালিয়ে নেয়। অর্থাৎ রোগের লক্ষণ সাধারণ অবস্থায় প্রকাশ পায়না। যদি দুটি জিনই অসুস্থ থেকে থাকে তাহলে তাদের স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে নেয়ার অবস্থা থাকে না। ফলে ঐ রোগটি প্রকাশ পায় এবং তাকে ডিজিজ বলে। কম্বাইন্ড হেটেরোজাইগোট বলা হয় যখন দুটি জিনই অসুস্থ তবে ভিন্ন রকমে অসুস্থ। যেমন একটি বিটা থ্যালাসেমিয়ায় অপরটি হিমোগ্লোবিন ই দ্বারা আক্রান্ত থাকে। যদি কোন দম্পতি উভয়েই ট্রেইট বা বাহক হয়ে থাকে তবে তাদের শতকরা ২৫ ভাগ বাচ্চা ডিজিজ হিসেবে আক্রান্ত হয় এবং তা ভয়ানক হতে পারে, যদিও ঐ দম্পতি নিজেরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। এরূপ বাচ্চাদের প্রায়ই বেচে থাকার জন্য নিয়মিত অন্যের রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। যার ফলে ঐ পরিবারে নেমে আসে এক মুক্তিহীন এক ভয়াবহ অশান্তি ও অর্থব্যয়ের স্থায়ী উপলক্ষ্য। বাকি বাচ্চারা ৫০ ভাগ বাবা মায়ের মত লক্ষণ বিহীন বাহক আর ২৫ ভাগ সম্পুর্ন সুস্থ্য হিসেবে জন্ম নেয়। কাজেই দুজন বাহক বা রোগী বা একজন বাহক ও একজন রোগীর মধ্যে বিয়ে হওয়া উচিৎ নয়।
যাইহোক, পরামর্শমত মেয়েটির বয়ফ্রেন্ডের হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষা করে দেখা গেল সেও বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক। রিপোর্ট দেখাতে এসে মেয়েটা কাঁদছে। খুব শক্ত কথাটি আমাকে বলতে হলনা। মেয়েটিই বলে যাচ্ছে।
…… আমি জানি স্যার, আপনি কি বলবেন। …… ওকে একটু বুঝান। ……… আমি ওকে বুঝিয়েছি, স্যার। আমি বলেছি আমরা বন্ধু হিসেবে থাকব। এই জীবনে স্বামী স্ত্রী হতে পারছিনা। তো কি হয়েছে ……. দোয়া করুন, স্যার, যাতে আমরা পরকালে বেহেস্তবাসি হয়ে স্বামী-স্ত্রী হতে পারি। ….. কি দরকার জেনে বুঝে দুনিয়াতে অসুস্থ্য মানব সন্তান পয়দা করার। ……
বুঝানোর মত অবস্থা দেখছিনা। ছেলেটি ভাবলেশহীন, তার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। অধিক শোকে পাথর হলে যা হয় আর কি। সম্বিত ফিরে আসতে মনে হয় আরও সময় লাগবে। আমি আর কি বুঝাবো। নিজেরাই যেখানে বুঝে। আমি শুধু তাদের ব্যাথার সাক্ষী হওয়ার চেষ্টা করলাম।
Comments
প্রেম ও জীবন — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>