ব্লাড ক্যান্সার নয়, কিন্তু ব্লাড ক্যান্সারের চেয়ে ভয়ংকর
পাঁচ বছরের ফুটফুটে ছেলেটি আমাকে তার হাত, পা, পেট দেখাচ্ছিল। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কালচে দাগ। অনেকটা আঘাত পেলে যেমন চামড়ায় কালো দাগ হয়। ফোনে আমাকে বলা হয়েছিল বাচ্চাটির প্লেটলেট কম। মানে রক্তের অণুচক্রিকা যাকে বলে বাংলা বা তৎসম সংস্কৃতে। বাংলা নামটা একটু কঠিন। ছোট বেলায় পড়তে গিয়ে দাঁতে ব্যাথা হয়ে যেতো। রক্তের প্রধান তিনটি সেল বা কোষের একটি এটি। কোথাও কেটে গেলে সেখান থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা এর কাজ। স্বাভাবিক বা সুস্থ অবস্থায় প্রতি মাইক্রো লিটার রক্তে এর সংখ্যা থাকে দেড় থেকে চার লাখ। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আরও বেশী। দুই থেকে পাঁচ লাখ। কমে গেলে অল্পতেই রক্তক্ষরণ হয়। এই দাগগুলো চামড়ার ভিতরে ও নীচে রক্তক্ষরনের লক্ষণ। বাচ্চার বাবা সিবিসি রিপোর্টটি হাতে দিয়ে কথা বলছিলেন। একজন হেমাটোলজিস্টের করা রিপোর্ট। দেখলাম শুধু প্লেটলেট না, সবই কম। প্যানসাইটোপেনিয়া যাকে বলে। লিউকেমিয়াতেও প্যানসাইটোপেনিয়া হতে পারে।কিন্তু সেক্ষেত্রে জ্বর বা চেহারায় যেমন একটা টক্সিক ভাব থাকে সেরকমটি নেই।
বাচ্চার বাবার সাথেই কথা বলছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, দাঁতের গোড়ায় রক্তক্ষরণ হয়?
না।
নাক দিয়ে?
তাও না।
জ্বর?
এবার বাচ্চাটিই উত্তর দিল, না, আংকেল। আমার তো জ্বর হয় না। জণ্ডিস হয়েছিল, জণ্ডিস।
তার বাবা বলে যাচ্ছিল, মাস তিনেক আগে জণ্ডিস হয়েছিল। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা উঠেছিল ২৪-এ।
ও, মাই গড!!
সব ভাইরাস টেস্ট করা হয়েছে।
এতো বেশি মাত্রার জণ্ডিস সাধারণত হেপাটাইটিস বি-তে হয়। সমস্ত কাগজ তন্ন তন্ন করে খুজলাম। হেপাটাইটিস এ, সি, ই -এর রিপোর্ট পাওয়া গেলো। কিন্তু বি -এর রিপোর্ট পেলামনা। হয়ত কোথাও মিসিং হয়ে গেছে। এই একটি ভাইরাল হেপাটাইটিস, যার অন্যতম একটা খুবই খারাপ সিকোয়েন্স হল এপ্লাস্টিক এনিমিয়া। সাধারণত যে জটিলতা হয় তা হল ক্রোনিক লিভার ডিজিজ বা সিরোসিস। তাতেও প্যানসাইটোপেনিয়া হতে পারে। তবে তা সাধারণত বেশি মাত্রায় হয়না বা শুরুতে বুঝা যায়না, মানে লক্ষণ থাকেনা। স্প্লিনের সাইজ বড় থাকে। হাত দিয়ে দেখলাম। হাতে পাওয়া যায়না। একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট আছে। নরমাল। মানে লিভার স্প্লিনে এখন কোন সমস্যা নাই। রক্তের রিপোর্ট আর তার লক্ষণ দেখে মনে হল এপ্লাস্টিক এনিমিয়া। লিভারের টিস্যু আর বোনম্যারোর টিস্যুর মধ্যে একটা চাচাতো মামাতো কাজিন টাইপের সম্পর্ক পাওয়া আছে। একারনে হেপাটাইটিস বিশেষ করে বি ভাইরাস দিয়ে হেপাটাইটিস হলে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা বোনম্যারোকে নষ্ট বা অক্ষম করে দেয়। ফলে রক্তের তিন ধরণের সেলেরই উৎপাদন কমে বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে হিমোগ্লোবিন কমে গিয়ে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। শ্বেত কণিকা কমে গিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ফুসফুস বা শরীরের যেকোন স্থানে বিশেষ করে রক্তেই ইনফেকশন হতে পারে। প্লেটলেট কমে গিয়ে বিশেষ করে দাঁতের গোরা বা নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই অবস্থার নামই হচ্ছে এপ্লাস্টিক এনিমিয়া। মারাত্মক অবস্থা হলে সাময়িক ভাবে রোগীকে বাচিয়ে রাখার জন্য অন্যের শরীর থেকে রেড সেল ও প্লেটলেট দেয়া হয়। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টই এর সর্বোত্তম চিকিৎসা। তবে সবার জন্য তা করা হয় না। খুব মারাত্মক ক্ষেত্রে তা করা হয়। মারাত্মক বলতে মারাত্মক রক্তশূন্যতা অর্থাৎ হিমোগ্লোবিন বেশি মাত্রায় কমে যাওয়া এবং এ কারনে যদি বার বার রক্ত গ্রহনের প্রয়োজন হয়। কিংবা প্লেটলেট কমে যাওয়া এবং তার জন্য বার বার অন্যের প্লেটলেট নেয়া। লিউকোসাইট বা শ্বেত কণিকা কমে যাওয়া, ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
আমার বাচ্চার ক্ষেত্রে কি এই চিকিৎসা লাগবে।
দেখুন, আপনার বাচ্চার এপ্লাস্টিক এনিমিয়া হয়েছে কিনা তা এখনো নিশ্চিত হওয়া বাকি আছে। যদি তা হয়েও থাকে তবে তা এখনো মারাত্মক বলে বুঝার জন্য বাকি পরীক্ষা গুলো দরকার। তবে রক্তক্ষরণ হওয়াটা মারাত্মক রোগের লক্ষণ।
শুনেছি দেশে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট চিকিৎসা চালু হয়েছে?
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত অটোলোগাস বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট চালু রয়েছে, সেটা এই রোগের জন্য নয়। কিছু ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য তা দেয়া হচ্ছে।
বিদেশে কেমন খরচ হয়?
শুনেছি পার্শ্ববর্তী দেশের সেন্টারগুলোতে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ লাখ খরচ হয়।
চোখ দুটো কপালে তুলে, চল্লিশ পঞ্চাশ …. ?
…… লাখ টাকা। তার উপর শর্ত আছে। ডোনার থাকতে হবে। ভাই বোনের মধ্যে। আপনার বাচ্চা কয় জন?
এর বড় আরেকটা মেয়ে আছে।
ভাই বোনের মধ্যে ডোনার না থাকলে অনাত্মীয় অপরিচিত ডোনারের ক্ষেত্রে আরও অতিরিক্ত খরচ যাবে।
ডাক্তার সাহেব এ তো বড়লোকের অসুখ।
হুঁম। ব্লাড ক্যান্সার নয়, তবে ব্লাড ক্যান্সারের চেয়েও খারাপ।
আমার বাচ্চা কি তাহলে বাঁচবে না?
চিন্তা করবেন না। যাদের ক্ষেত্রে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বিভিন্ন কারণে দেয়া সম্ভব নয় তাদেরকে বিকল্প হিসেবে ইম্যুনো সাপ্রেসিভ চিকিৎসা দেয়া হয়। আমরা আমাদের দেশে তাই দিয়েই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে কিছু কোম্পানি এই ওষুধ এনে থাকে। এই ওষুধও দামী। তবে অনেকের নাগালের মধ্যে।
বললাম, বোনম্যারো সহ বাকি পরীক্ষাগুলো করে নিন। আগে রোগ নির্নয়। রোগ নিশ্চিত হোক। তারপর আপনার সাথে বাকি কথা হবে। জানতে চাইলেন বলে অনেক কথা বললাম। অন্য কিছুও তো হতে পারে।
অন্য কিছু হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না। মিথ্যা আশা দিলাম মনে হয়। নিশ্চিত হওয়ার আগেই অনেক কথা বলে ফেলেছি। খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল আগেই এতো বেশী কথা বলা ঠিক হয় নি। বাবাটি এতক্ষনে চুপ হয়ে গেছেন। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। বাংলায় যাকে বলে বজ্রাহত। পরিবেশটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেলে। বাচ্চাটির মা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। শেষ পর্যন্ত আর সামলাতে পারলেন না। চোখের কোনায় পানি জমেছিল। গড়িয়ে পরার আগেই আঁচলে মুছতে লাগলেন। বাচ্চাটি স্টেথোস্কোপ নিয়ে নিজের বুকে লাগাচ্ছে। নিজের হার্টবিট শোনার চেষ্টা করছে। বাবা মায়ের হার্টবিট বুঝার বয়স যে এখনো হয়নি। বাবার অভিব্যক্তি আর মায়ের অশ্রু তার দৃষ্টিগোচর হলনা।
Comments
ব্লাড ক্যান্সার নয়, কিন্তু ব্লাড ক্যান্সারের চেয়ে ভয়ংকর — No Comments
HTML tags allowed in your comment: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>