থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ যার প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকা। বংশগত অর্থ এই রোগ আজীবন অনিরাময়যোগ্য। এই রোগে আক্রান্ত শিশুকে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি মোকাবেলায় আজীবন অন্যের রক্তের উপর নির্ভর করতে হয়। দেশের ৪-৬% মানুষ থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংকে সংগৃত মোট রক্তের ৪০% থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য ব্যয় হয়। রক্ত সংগ্রহ ও গ্রহণ সম্পর্কিত নানা জটিলতার জন্য থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পরিবার এক জটিল মানবিক ও আর্থিক অবস্থার সম্মুখীন হয়। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া জিন বহনকারী সকলেই যে অন্যের রক্তের উপর নির্ভরশীল হয় তা কিন্তু নয়। সাধারণত মানবদেহের প্রতিটা বৈশিষ্টের জন্য এক জোড়া করে জিন দায়ি থাকে। এই জোড়ার একটি আসে মায়ের শরীর থেকে, আরেকটি আসে বাবার শরীর থেকে। এই জিন দু’টির যেকোন একটি সুস্থ্য থাকলে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়না। এর অর্থ হল যখন কোন দম্পতির উভয়ে অসুস্থ্য জিন বহন করে এবং দুর্ভাগ্যক্রমে উভয়ের অসুস্থ্য জিন দু’টি শিশুর শরীরে প্রবেশ করে তখন ঐ শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। অর্থাৎ অসুস্থ্য জিন বহনকারী বা বাহকদের মধ্যে বিবাহ না হওয়াই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের একমাত্র কার্যকর উপায়।

দেশে দেশে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক কর্মসূচীঃ

সত্তুরের দশকে প্রথমবারের মত ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চল তথা সাইপ্রাস, সার্দিনিয়া (ইতালি) ও গ্রিসে থ্যালাসেমিয়া নির্মুল ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। পরবর্তিতে তা সম্প্রসারিত হয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, কিউবা, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানী ও ইরানসহ বিভিন্ন দেশে। এসব দেশের বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে আছে বাহক নির্নয়, কাউন্সেলিং ও অনাগত সন্তানের ভ্রূণ পরীক্ষা করা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বাহক নির্নয় ও কাউন্সেলিং-এর জন্য দেশগুলোর স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সাইপ্রাস, লেবানন, ইরান, সৌদি আরব, তিউনিসিয়া, ইউএই, বাহরাইন, কাতার ও প্যালেস্টাইনের গাজা উপত্যকায় বিয়ের সময় পাত্রপাত্রীর থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। যদিও এসব দেশে বাহকে বাহকে বিয়ে নিষিদ্ধ নয় এবং এরূপ ক্ষেত্রে বিয়ের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট পাত্রপাত্রীর এখতিয়ারাধীন। চীনে বিবাহপূর্ব থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল যদিও তা পরবর্তিতে ঐচ্ছিক করা হয়েছে। মালয়েশিয়া এবং উপমহাদেশের মালদ্বীপ ও শ্রীলংকায় বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে রক্ত পরীক্ষা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের পার্লামেন্ট থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইনে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর রক্তজ আত্মীয় স্বজনদের রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। অতি সম্প্রতি ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেদেশের সকল গর্ভবতী মহিলার থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য একটি আইনের প্রস্তাব করেছে যা এখন পরীক্ষা নিরীক্ষাধীন রয়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি মহামান্য আদালত বিয়ের আগে বর-কনের রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করেছেন। এর কয়েকদিন পরই রাজধানীতে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক একটি জাতীয় কর্মশালায় মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী আদালতের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক রক্ত পরীক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। থ্যালাসেমিয়া মহামারি প্রতিরোধে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করা ও তা পক্ষদ্বয়কে অবহিত করার জন্য আইন প্রনয়ণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। পৃথিবীর যেসব দেশেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ হয়েছে সেখানেই আইন একটি গুরুত্বপূর্ন অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। তবে যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে তা হল যে আমরা এখনো প্রস্তুত নই। কিন্তু এটাও সত্য যে আইনের উপস্থিতিও গণসচেতনতা আনতে সহায়তা করে ও জটিল সামাজিক পরিস্থিতিকে সহজ করে।

আমাদের করণীয়ঃ

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ও থ্যালাসেমিয়া মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর জন্য কয়েকটি প্রজন্ম পার হতে হয়। বিশ্বের যেসব দেশে থ্যালাসেমিয়া কর্মসূচী সফল হয়েছে তা একদিনে সম্ভব হয়নাই। তাদেরকে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থায় আসতে হয়েছে। আমরা সেসব দেশের তুলনায় অনেক পরে শুরু করলেও আমাদের সুবিধা এই যে সেসব দেশের মত অত বেশি সামাজিক পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হবেনা। কারণ তাদের পরিণত অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে বিদ্যমান। তাদের অভিজ্ঞতা এবং গৃহীত কর্মসূচী ও আইন পর্যবেক্ষন করে সহজেই আমরা আমাদের কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারি।

প্রথমত, জনসচেতনতাঃ যে কোন জনস্বাস্থ্য সমস্যা দূর করতে জনসচেতনতার বিকল্প নাই। গণসচেতনতার জন্য লিফলেট ও পোস্টারিং, বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন ও আর্টিকেল প্রকাশ, টকশো এবং সরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে কম্যুনিটিতে আলোচনা সভার আয়োজন করার প্রস্তাব ও অভিজ্ঞতা বিভিন্ন আলোচনায় এসেছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ে থ্যালাসেমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তবে সচেতনতা সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন টার্গেট পপুলেশন হচ্ছে যারা স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত, স্বাস্থ্য প্রশাসক ও পলিসি মেকার থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কর্মী। তাদের থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক জ্ঞান ও সচেতনতার উপর নির্ভর করে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে নীতি নির্ধারন এবং থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও রোগীদের কাউন্সেলিং ও চিকিৎসা। সার্দিনিয়ার টার্গেট পপুলেশনের ৭০% ভাগের সচেতনতা তৈরি হয় তাদের ডাক্তারদের মাধ্যমে। একটি প্রশ্ন আছে যে সচেতনতা সৃষ্টির লেভেল ও কৌশল কি হবে? আমাদের একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে থ্যালাসেমিয়া কোন একোয়ার্ড রোগ নয়, একটি জেনেটিক রোগ। এখানে রোগী বা বাহকের কোন দোষ নাই, তারা এর জন্য দায়ী নয়। এইডস সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করে এইডস নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং তা সফল ভাবে করাও হয়েছে। কিন্তু থ্যলাসেমিয়ার বিষয়টি জটিল ও সেন্সিটিভ। যেমন ধরুন আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে জনগণকে এর ভয়বহতা সম্পর্কে সচেতন করলাম। সবাই জানলো বাহকে বাহকে বিয়ে করা যাবেনা এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থা জেনে নিলো। এ অবস্থায় আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুস্থ্য পাত্রপাত্রী বাহকদের বিয়ে করতে চাইবে না। বাহকদের তখন বাহকরাই বিয়ে করবে অথবা বাহকরা মিথ্যের আশ্রয় নিবে। এমনকি বাহকদের মধ্যে বিবাহ বহির্ভুত জীবন যাপনের অভ্যাস বেড়ে যেতে পারে। ফলে এর ভয়াবহতার বিষয়টি বেশী মাত্রায় হাইলাইট করলে সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশংকা আছে। কাজেই কম্যুনিটিতে সচেতনতার কাজ করতে গিয়ে রোগটি সম্পর্কে প্যানিক ছড়ানো ঠিক হবে না যা এইডসের মত রোগে করা যায়। সমাজে আমাদেরকে এর বাহক নিয়েই থাকতে হবে। সচেতনতা কর্মসুচির ধরণ যেন এরূপ হয় যে রোগটির উপস্থিতি সমাজে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য হয় এবং ফলতঃ রোগের বাহকরা যেন সমাজে অবাঞ্ছিত গণ্য না হয়। যে সব দেশে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে তার মূল কাজটি হয়েছে প্রিন্যাটাল স্ক্রিনিং করে। হ্যাঁ। আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচারণার মুল ফোকাস হবে প্রিন্যাটাল টেস্টিং। এর মাধ্যমে রোগাক্রান্ত ভ্রূণ চিহ্নিত করে তার জন্ম প্রতিহত করা। কিন্তু কাদেরকে আমরা প্রিন্যাটাল টেস্টিং করবো? যখন দেখব দম্পতির দুজনেই বাহক। এই বাহক নির্নয়ের জন্যই সচেতনতা বা সামাজিক শিক্ষা এবং আইনের চাপ। এই চাপটি এমনভাবে হতে হবে অনেকটা নিরবে, যেন বাহক নিজেকে অবাঞ্চিত মনে না করেন, সমাজে হেয় প্রতিপন্ন না হন।

দ্বিতীয়ত, বাহক নির্নয়ঃ বাহক নির্নয়ের জন্য বাংলাদেশের থ্যালাসেমিয়া আন্দোলনের সাথে জড়িতদের কাছ থেকেও বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে। এর মধ্যে কম্যুনিটিতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, যুবক যুবতী ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে স্ক্রিনিং কর্মসুচির কথা এসেছে। আমি মনে করি এটা বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে কঠিন ও ব্যয়বহুল হবে এবং তা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ের সম্ভাবনা তৈরি করবে। কথা এসেছে বিয়ের আগে ঘটক ও কাজীকে ইনভল্ভ করা সহ পাত্রপাত্রীর সচেতনতার মাধ্যমে স্ব-উদ্যোগে বাহক নির্নয়ের পরীক্ষা করার কথা। এবিষয়েও কেউ কেউ তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। ঘটক বা পাত্রপাত্রীর দ্বারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে। পেশাদার ঘটক বা কাজী কেউই তাদের সামাজিক অবস্থান হারাতে চাইবেন না। আমাদের সামাজিক অবস্থা এখনও এরূপ স্বউদ্যোগে বিবাহ পুর্ব পরীক্ষার জন্য উপযোগী নয়। এ অবস্থায় আইনের উপস্থিতি এধরণের কঠিন সামাজিক বাস্তবতাকে সহজ করে দিতে পারে। কথা এসেছে পাকিস্তানের আইনটির বিষয়ে। এই আইনে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল কেবল মাত্র ইতিমধ্যে নির্নিত বাহক ও রোগীদের রক্ত সম্পর্কিয় আত্মীয় স্বজনের জন্য এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই আইনের একটি গুরুত্বপুর্ণ অসুবিধা হচ্ছে আইনটি কেবলমাত্র থ্যালাসেমিয়া পরিবার কেন্দ্রিক হওয়ায় এতে আক্রান্ত পরিবারগুলো সামাজিকভাবে চিহ্নিত ও অবাঞ্ছিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এটা সামাজিক মর্যাদা ও অধিকারের নিরিখে অগ্রহণযোগ্য। এটার অগ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশটির আইন প্রণেতারাই অভিযোগ করেছেন। ভারতের প্রস্তাবিত আইনটি বেশ চমৎকার। এ আইনে শুধুমাত্র সম্ভাব্য মায়েদের রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। এই সব সম্ভাব্য মায়েরা যদি বাহক বা রোগী হিসেবে নির্নিত হয় তাহলেই কেবল তার স্বামীর পরীক্ষা বাধ্যমূলক হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে বাহক হলে গর্ভস্থ অনাগত শিশুর ভ্রূণ পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটিতে কোন গোষ্ঠী বা পরিবারকে টার্গেট করা হয়নি, ফলে কারও সামাজিকভাবে মর্যাদাহানীও হবেনা। শুধু তাই নয় এ ব্যবস্থায় বিশাল জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করা হচ্ছেনা বিধায় সরকারের ব্যয় সাশ্রয় হবে। কিন্তু আমাদের জনগোষ্টির প্রেক্ষাপটে এর নেগেটিভ বিষয়টি হচ্ছে এর বাস্তবায়ন। দেশের একটি বিশাল অংশ সরকারী বা বেসরকারি মাতৃস্বাস্থ্য সেবার বাইরে বা এ বিষয়ে অজ্ঞ। ফলে এই সব মায়েরা বাহক নির্নয় কর্মসূচীর বাইরে থেকে যাবে। এখানেই জনসচেতনতা কর্মসূচির উপযোগিতা বা কার্যকরিতা প্রমাণিত হয়। এই সচেতনতা কর্মসুচীই সহজ হবে যদি বিয়ের সময় কাবিননামার শর্ত হিসেবে বাধ্যতামূলক রক্ত পরীক্ষার ডকুমেন্ট চাওয়া হয়। কারণ অল্প কিছু ঘটনা বাদ দিলে আমাদের সমাজের বিবাহ প্রক্রিয়া কাবিন নামা বা কাজীর মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করার বিধান কার্যকর রয়েছে। সেখানে আইনের অযুহাতে এধরণের একটি কঠিন কাজ সহজ হবে। যেমন কাবিন নামার বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মধ্যে একটি আছে- ইহা বরের বা কনের দ্বিতীয় বিবাহ কিনা, হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আছে কিনা। তেমনি একটি অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা যেতে পারে- বরের ও কনের রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজনীয় রিপোর্ট আছে কিনা। এরকম রিপোর্ট থাকার শর্ত প্রাথমিক পর্যায়ে ঐচ্ছিক ও পরবর্তি সময়ে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এরকম থাকলে ডাক্তারের পরামর্শে তারা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে সচেতন হবে এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা খুব সহজেই তাদের মাতৃস্বাস্থ্য ও অনাগত সন্তানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারবে।

তৃতীয়ত, প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহঃ শুধু বাহক নির্নয়ের জন্য সচেতনতা ও আইনই যথেষ্ঠ নয়। সচেতনতা ও বাধ্যবাধকতার সাথে রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ সহজলভ্য করতে হবে। বর্তমানে ঢাকা ছাড়া সরকারীভাবে কোথাও থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী বিফল হতে বাধ্য। কেউ কেউ প্রস্তাব করেন প্রতিটা জেলা সদর হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ের ব্যাবস্থা তথা হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবার প্রশ্ন উঠেছে প্রতিটা জেলায় বা যত্রতত্র থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয়ের জন্য হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস করলে অনেক ভুল রিপোর্ট হবে। এই অবস্থায় অন্যান্য দেশের সিস্টেম অনুসরণ করা যায়। যেমন কোন কোন দেশে হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস বা এইচপিএলসির রিপোর্টে কোন কমেন্ট থাকেনা। বায়োকেমিস্ট্রি রিপোর্টের মত। বিষয়টা লক্ষণীয়। এই রিপোর্ট গুলো মেশিনে হয়। মেশিন অপারেটর মেশিন চালিয়ে যে রেজাল্ট পান তাই প্রিন্ট করে দেন। রেজাল্টের ব্যাখ্যা ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র দেয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের। আমাদের দেশেও সেরূপ করা যেতে পারে। মেশিন ও রিয়েজেন্ট সুলভ করা এবং মেশিন চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের টেকনোলজিস্টকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। জটিল কেসগুলো সংশ্লিষ্ট ফিজিশিয়ান নিজ দায়িত্বে হ্যান্ডেল করবেন। ফলে ভুল রিপোর্টের বা ভুল কমেন্টের জটিলতা থেকে জাতি মুক্ত থাকবে। টেস্টিং সুবিধা নিশ্চিত করা থ্যালাসেমিয়া কর্মসূচী সফল হওয়ার পূর্ব শর্ত।

চতুর্থত, আর্লি প্রিনেটাল টেস্টিং ও গর্ভপাতঃ সাধারণত এগারো বারো সপ্তাহেই গর্ভস্থ ভ্রূণের জেনেটিক পরীক্ষা করা যায়। কেবল মাত্র পিতামাতা উভয়েই যখন বাহক বা একজন বাহক আরেকজন রোগী হয় তখনই কেবলমাত্র এই পরীক্ষা প্রয়োজন হয়। এই পরীক্ষায় যদি প্রমাণিত হয় যে গর্ভস্থ শিশু মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত অর্থাৎ বিটা থ্যালাসেমিয়া ডিজিজ বা ইবিটা হেটেরোজাইগাস থ্যালাসেমিয়া তাহলে অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যা করে গর্ভপাতের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়। বলা বাহুল্য যে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত মেডিকেল ইথিক্স অনুযায়ী গর্ভপাতের মত সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট পিতামাতার কাছ থেকে আসতে হয়। প্রায়ই এধরণের গর্ভপাত সহজ হয়না। এর কারণ হল প্রথমতঃ মাতৃত্বের আবেগ। অনাগত মারাত্মক ভবিষ্যৎ বুঝতে পারার পরও মাতৃত্বের টানে গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট করতে অনীহা। অনীহার কারণে সিদ্ধান্তহীনতা, সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দেরী এবং দেরীর কারণে মাতৃস্বাস্থ্য আরও বেশী ঝুঁকিতে পড়ে। এই পয়েন্টে সচেতনতা কর্মসূচি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দ্বিতীয়তঃ আইনের অনুপস্থিতি। দেশে আট সপ্তাহের কম বয়সী ভ্রূণ হত্যা অর্থাৎ এমআর নিষিদ্ধ নয় এবং এর জন্য কোন কারন দেখানোরও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া বা কোন জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত ভ্রূণ চিকিৎসা বা জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে গর্ভপাত বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট আইন আছে কিনা বা কি ধরণের আইন আছে তা আমি বা আমার মত অনেক চিকিৎসকই জানিনা। বর্তমানে বেশীরভাগ দেশেই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত অনাগত শিশুর ভ্রূণ চার মাসের মধ্যে বিনষ্ট করা অবৈধ বলে বিবেচনা করা হয় না। যদিও দেশে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত গর্ভস্থ শিশুর গর্ভপাত হচ্ছে, তবুও প্রসূতি বিশেষজ্ঞরাও অনেকেই পারতপক্ষে আইনের ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী; বিশেষ করে প্রাইভেট প্রাক্টিসে। এ ধরণের কেসগুলো তারা ইন্সটিটিউট হাসপাতালে রেফার করতে আগ্রহী। অনেকেই ধর্মীয় অনুভূতির কারণে এধরণের কেস নিতে চান না। কাজেই থ্যালাসেমিয়া ও অন্যান্য মারাত্মক জন্মগত ত্রুটিপুর্ন ভ্রূণ বিনষ্টের জন্য সুস্পষ্ট আইন দরকার। এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতাও গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা রাখতে পারে।

পঞ্চমত, বাহকে বাহকে বিয়ে নিরুৎসাহিত করণঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম প্রতিরোধে বাহকে বাহকে বিয়ে বন্ধই একমাত্র প্রতিরোধ মূলক উপায় হলেও বিষয়টি সহজ নয়। এটি আইন করে করা যায়না এবং তা মানবাধিকার পরিপন্থী। এ ধরণের আইন করা হলে বাহক ও রোগীদেরকে সমাজে অবাঞ্ছিত করা হবে। তারা সমাজে নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে চিহ্নিত হয়ে পড়বে। তাদেরকে সম্পুর্ন সুস্থ ব্যক্তিরাও বিয়ে করতে চাইবেনা। ফলে অনেকেই বিবাহ বহির্ভুত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে এবং তাতে সামাজ দুর্বল হয়ে পড়বে। পৃথিবীর কোথাও এধরণের আইন নাই। যে কয়টি দেশে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক আইন আছে তার সবগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বিবাহপুর্ব ও প্রিনেটাল পরীক্ষা। বিয়ে নিষিদ্ধ করতে আইন নয়। বরং আইনের উদ্দেশ্য হবে বিয়েতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সম্ভাব্য বাহক দম্পতি চিহ্নিত করা, বাহক দম্পতির অনাগত থ্যলাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর ভ্রূণ চিহ্নিত করা ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বাহকে বাহকে বিয়ে নিরুৎসাহিত করা। এই নিরুৎসাহিত করার কাজটি হবে ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সতর্কভাবে যাতে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি না হয়। দেশে যখন বাহক চিহ্নিতকরণ ও প্রিনেটাল টেস্টিং স্বাভাবিক কার্যক্রমে পরিণত হবে তখন বাহকে বাহকে বিয়ে নিরুৎসাহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে।

সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কর্মসুচী ও পাঠ্যপুস্তকে থ্যালাসেমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করণ, কাবিননামায় থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক তথ্য সন্নিবেশ বাধ্যতামূলক করণ, প্রিনেটাল টেস্টিং ও আক্রান্ত ভ্রূণ বিনষ্টের বিষয়ে সুস্পষ্ট আইনের উপস্থিতি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বাহকে বাহকে বিয়ে নিরুৎসাহিত করণের মাধ্যমে আমরা থ্যালাসেমিয়া মুক্ত বা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র গঠন করতে পারি।